শস্য দ্রব্যের বিনিময়ে অর্থ প্রদান করার বিধান
শস্য দ্রব্যের বিনিময়ে অর্থ প্রদান করার বিধান
মুফতী রাফিক আলম বারকাতী মিসবাহী
প্রধান শিক্ষক: জামেয়া রাযাভিয়া পঞ্চানন্দপুর, মোথাবাড়ি, মালদা।
সাদকায়ে ফিতর: প্রত্যেক মালিকে নিসাব মুসলমান স্বাধিন, অ স্বাধিন, পুরুষ, মহিলা, ছেলে, মেয়ে ছোট, বড় সকলের উপর ওয়াজিব।عَنْ عَبْدِ اللّٰہِ بْنِ ثَعْلَبَۃَ بْنِ صُعَیْرٍ الْعُذْرِیِّ رضی اللہ عنہ قَالَ: خَطَبَ رَسُوْلُ اللّٰہِ صلی اللہ علیہ وآلہ وسلم النَّاسَ قَبْلَ الْفِطْرِ بِیَوْمَیْنِ فَقَالَ: اَدُّوا صَاعًا مِنْ بُرٍّ اَوْ قَمْحٍ بَیْنَ اثْنَیْنِ اَوْ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ اَوْ صَاعًا مِنْ شَعِیْرٍ عَلَی کُلِّ حُرٍّ وَعَبْدٍ وَصَغِیْرٍ وَکَبِیْرٍ হজরত আব্দুল্লাহ বিন সা’লাবা বিন সুয়াইর উযরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হুজুর সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দুদিন পূর্বে মুসলিম জনগণকে সম্বোধন করে বললেন যে, তোমরা এক সা গম দুজনের পক্ষ থেকে অথবা এক সা খেজুর অথবা এক সা জব মুসলমান স্বাধিন, অ স্বাধিন , ছোট ও বড় এর পক্ষ থেকে সাদকায়ে ফিতর আদায় করো। (মুসনাদে আহমাদ কিতাবুয যাকাত হাদিস নম্বর ৩৫৬৮)
আবু দাউদ শরীফে হজরত হাসান বাসারী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত خَطَبَ ابْنُ عَبَّاسٍ رَحِمَهُ اللَّهُ فِي آخِرِ رَمَضَانَ عَلَى مِنْبَرِ الْبَصْرَةِ، فَقَالَ: أَخْرِجُوا صَدَقَةَ صَوْمِكُمْ، فَكَأَنَّ النَّاسَ لَمْ يَعْلَمُوا، فَقَالَ: مَنْ هَاهُنَا، مِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ قُومُوا إِلَى إِخْوَانِكُمْ فَعَلِّمُوهُمْ، فَإِنَّهُمْ لَا يَعْلَمُونَ، فَرَضَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَذِهِ الصَّدَقَةَ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ أَوْ شَعِيرٍ أَوْ نِصْفَ صَاعٍ مِنْ قَمْحٍ عَلَى كُلِّ حُرٍّ أَوْ مَمْلُوكٍ، ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى، صَغِيرٍ أَوْ كَبِيرٍ অর্থাৎ হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু রমযান শেষে বাসারাতে মেম্বারে বক্তব্য রেখে বললেন, তোমরা রোজার সদকা আদায় করো। জনসাধারণ বুঝতে পারলো না। তখন হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন এখানে মদিনা বাসী কে আছেন ? দাঁড়ান। তাদেরকে সাদকায়ে ফিতর সম্বন্ধে বুঝিয়ে দিন। তারা জানেনা যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আজাদ, গোলাম পুরূষ, মহিলা ছোট, বড় সকলের পক্ষ থেকে এক সা খেজুর অথবা এক সা জব অথবা অর্ধেক সা গম ফিতরা হিসেবে আদায় করা ওয়াজিব করেছেন। (আবু দাউদ শরীফ কিতাবুয যাকাত হাদিস নম্বর ১৬২২)
হজরত আয়াজ বিন আব্দুল্লাহ বিন সায়াদ বিন আবু সারহ আল আমরী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু মাধ্যম বর্ণিত يَقُولُ : كُنَّا نُخْرِجُ زَكَاةَ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ أَقِطٍ أَوْ صَاعًا مِنْ زَبِيبٍ অর্থাৎ হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন আমরা সাদকায়ে ফিতর হিসেবে এক সা শস্য দ্রব্য অথবা এক সা জব অথবা এক সা খেজুর অথবা এক সা পণীর অথবা এক সা কিসমিস আদায় করতাম।(বুখারী শরীফ কিতাবুয যাকাত হাদিস নম্বর ১৫০৬) শস্য দ্রব্য বলতে কি বুঝায় সে বিষয়ে হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন كُنَّا نُخْرِجُ فِي عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ، وَقَالَ أَبُو سَعِيدٍ : وَكَانَ طَعَامَنَا الشَّعِيرُ وَالزَّبِيبُ وَالْأَقِطُ وَالتَّمْرُ অর্থাৎ আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র সময় কালে এক সা শস্য দ্রব্য সাদকায়ে ফিতর হিসেবে আদায় করতাম। এবং তিনি আরো বলেন আমাদের শস্য দ্রব্য ছিল জব, কিসমিস, পানির এবং খেজুর। (বুখারী শরীফ কিতাবুয যাকাত হাদিস নম্বর ১৫১০) উক্ত হাদিস গুলি হতে দুটি জিনিস স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। প্রথমত সাদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। দ্বিতীয়ত সাদকায়ে ফিতর হিসেবে কেবল অর্ধেক সা গম ওয়াজিব নয়। বরং তার সাথে সাথে উপরোক্ত চারটি শস্য দ্রব্যের মধ্যে যেকোনো একটি এক সা পরিমাণ আদায় করলে সাদকায়ে ফিতর আদায় হয়ে যায়।
বর্তমানে আমরা সাদকায়ে ফিতর হিসেবে কেবল অর্ধেক সা গম বা তার মূল্য আদায় করে থাকি। এবারে দেখার বিষয় হচ্ছে উক্ত শস্য দ্রব্য গুলি না দিয়ে তার বিনিময়ে মূল্য আদায় করলে সাদকায়ে ফিতর আদায় হবে কি ? আসুন দেখি এ সম্বন্ধে কোরআন ও হাদিস বিশারদ কারী সম্মানীয় ফাকীহগণ কি বলেন। ইমাম আবু বকর বিন আলী বিন মুহাম্মদ আল হাদ্দাদ রহমাতুল্লাহি তাআলা আলাইহি (ইন্তেকাল ৮০০হিজরী) বলেন عندنا: یجوز ان یعطی عن جمیع ذٰلک القیمة دراھم و فلوسا و عروضا، لقولہ علیہ الصلوة السلام " أغنوھم عن المسألة فی مثل ھذا الیوم" অর্থাৎ হানাফীগণের নিকট প্রত্যেকটি শস্য দ্রব্যের দিরহাম ও টাকা পয়সা রূপে মূল্য আদায় করা জায়েজ কেননা দয়ার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন এই দিনে (ঈদের দিনে) ফকীর মিসকীনদের কে লোকসম্মুখে হাত প্রসারিত করা থেকে মুক্তি দাও। (আল জাওহারাতুন নাইয়িরাহ প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা নম্বর ৩২৫) এবং (আদ দেরায়া ফী তাখরীজিল হিদায়া প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা নম্বর ২৭৪ হাদিস সংখ্যা ৩৫৭) আরো লিখেন ذکر فی الفتاوی: ان اداء القیمة افضل و علیہ الفتوی لانہ ادفع لحاجة الفقیر অর্থাৎ ফাতাওয়াতে উল্লেখিত আছে মূল্য আদায় করা উত্তম এবং এর উপরেই ফতোয়া রয়েছে কেননা ফকির মিসকিনদের প্রয়োজন পূরণে এটাই বেশি দরকার। (সাবেক হাওয়ালা)
ইমাম আব্দুল্লাহ বিন মাহমূদ আল মূসিলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (জন্ম ৫৯৯ হিজরী ইন্তেকাল ৬৮৩ হিজরী) লিখেন قال ابو یوسف رحمہ اللہ: الدقیق احب الیّ من الحنطة، الدراھم احب الیّ من الدقیق لانہ ایسر علی الغنی و انفع للفقیر অর্থাৎ ইমাম আবু ইউসুফ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন আমার নিকট গম থেকে আটা আদায় করা অতি উত্তম এবং আটা থেকে দিরহাম(বর্তমান টাকা) আদায় করা অতি উত্তম কেননা তাতে ধনী ব্যক্তিদের জন্য সহজ ও গরিব ব্যক্তিদের জন্য অধিক উপকারী। (আল ইখতিয়ার লি তালিলিল মুখতার প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা নম্বর ৩৮৯) দেখুন হযরত আবু ইউসুফ রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলাইহি (জন্ম ১১৩ হিজরী ইন্তেকাল ১৮২ হিজরী) যিনি হযরত ইমামে আজম আবু হানিফা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর ছাত্র এবং ইসলামী ইতিহাসে সর্বপ্রথম সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের প্রধান বিচারপতি উনি বলেন গমের তুলনায় তার আটা এবং আটার তুলনায় টাকা দেওয়া বেশি ভালো। তিনি প্রায় সাড়ে বারশত বছর পূর্বে এ ধরনের বক্তব্য ঘোষণা করে গেছেন।
আল মুহাক্কিক ইমাম আব্দুর রহমান বিন মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি যহীরিয়ার কওল নকল করেন ان الفتوی علی ان القیمۃ افضل অর্থাৎ মূল্য আদায় করা অতি উত্তম এবং এটার উপরই ফতোয়া রয়েছে। (মাজমাউল আনহুর প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা নম্বর ৩৩৯) ফাতাওয়া আলামগিরীতে রয়েছে ذکر فی الفتاوی: ان اداء القیمة افضل من عین المنصوص علیہ و علیہ الفتوی অর্থাৎ ফাতাওয়াতে লিপিবদ্ধ আছে উপরোক্ত হাদিসে উল্লেখিত শস্য দ্রব্য এর তুলনায় তার মূল্য আদায় করা অতি উত্তম এবং এটার উপরেই ফতোয়া রয়েছে। (ফাতাওয়া আলামগিরী প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা নম্বর ২১১)
ইমাম ইবনে আবেদীন শামী রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি ফাতাওয়া শামীতে বর্ণনা করেন لان العلة فى افضلية القيمة كونها اعون على دفع حاجة الفقير لاحتمال أنه يحتاج غير الحنطة مثلا من ثياب و نحوها অর্থাৎ গরিব মিসকিনদের প্রয়োজন পূরণে টাকা পয়সার বেশি দরকার ফলে মূল্য আদায় করা অতি উত্তম। কারণ তাদের গম ছাড়াও অন্যান্য জিনিসের প্রয়োজন পড়তে পারে যেমন কাপড় বা অন্য কিছু। (রাদ্দুল মুহতার তৃতীয় খণ্ড পৃষ্ঠা ৩২২) উপরোক্ত সমস্ত দলিলাদি থেকে এটাই প্রতিয়মান হয় যে শস্য দ্রব্য এর তুলনায় তার মূল্য আদায় করা জায়েজ ও উত্তম। তবে হ্যাঁ কেউ যদি শস্য দ্রব্যগুলি সরাসরি দেয় তাহলে তাতে কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু মূল্য আদায় করাই সকল হানাফী ফাকীহগণের মতে জায়েয ও অতি উত্তম।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : বর্তমান কালে কিলোগ্রাম হিসেবে এক সা পরিমাণ ওজন ৪ কিলো ৯৪ গ্রাম এবং অর্ধেক সা পরিমাণ ওজন ২ কিলো ৪৭ গ্রাম।
ইতি:-
(মুফতি ) মুহাম্মদ রাফিক আলাম বারকাতী মিসবাহী।
প্রধান শিক্ষক: জামেয়া রাযাভিয়া পঞ্চানন্দপুর মোথাবাড়ি মালদা।
Comments -