হযরত ইমাম মালিকের সংক্ষিপ্ত জীবনী
হযরত ইমাম মালিকের সংক্ষিপ্ত জীবনী
মাওলানা কলিমুদ্দীন মিসবাহী, মুর্শিদাবাদ
ভূমিকা
ইমাম মালিক ছিলেন মালিকি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা, মুয়াত্তা গ্রন্থের সংকলক, মুহাদ্দিসগণের প্রথম স্তরের এক বিখ্যাত ইমাম ও একজন বিখ্যাত তাবে'- তাবেয়ী।
ইসলামের ইতিহাসে যেসব ইমামরা ধর্মীয় জ্ঞান ও ফিক্বহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের মধ্যে ইমাম মালিক ইবনে আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন অন্যতম। তিনি ছিলেন ফিকহের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি তার জ্ঞান ও শিক্ষা দিয়ে মুসলিম উম্মাহকে সমৃদ্ধ করেছেন। ইমাম মালিকের জীবনের প্রতিটি ধাপে কোরান, সুন্নাহ এবং সাহাবীদের শিক্ষা ছিল তার পথনির্দেশক। তার প্রতিষ্ঠিত মালিকি মাযহাব আজও বিশ্বের অনেক অঞ্চলে অনুসৃত হয়। ইমাম মালিকের জীবনী আমাদেরকে ইসলামী জ্ঞান অর্জন, ন্যায়পরায়ণতা এবং আধ্যাত্মিকতার গুরুত্ব শিক্ষা দেয়। তার জীবন ও কর্ম আমাদের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস, যা ইসলামী আদর্শ মেনে চলার পথ দেখায়।
নাম ও বংশ পরিচয়: নাম মালিক, উপনাম আবু আব্দুল্লাহ, উপাধি শাইখুল ইসলাম, ইমামু দারিল হিজরা, আলীমে মাদিনা ইত্যাদি।
বংশ নামা: মালিক বিন আনাস বিন মালিক বিন আবু আমির বিন আমর বিন হারিস আল-আসবাহী।
ইমামে মালিকের পূর্বপুরুষ ইয়ামিনের অধিবাসী ছিলেন তার প্রপিতামহ (Great grandfather)
আবু আমির একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী ছিলেন, দ্বিতীয় হিজরীতে (৬২৩ খ্রীস্টাব্দে) ইসলাম গ্রহণের পর স্বপরিবারে মদিনা তাশরিফ আনায়ন করেন।
ইমামে মালিকের বংশ পরম্পরা ইয়ামীনের শাহী খানদান হুমাইয়ের শাখা "আসবাহ" এর সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার কারণে তাকে আল-আসবাহী বলা হয়।
জন্মগ্রহণ: ইমামে মালিকের জন্মের সন নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ ৯৩ হিজরিতে (৭১১ খ্রিস্টাব্দ) পবিত্র নগরী মদিনা মুনাওয়ারায় জন্মগ্রহণ করেন।
(তাযকিরাতুল হুফ্ফায, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৫৭)
শিক্ষা অর্জন:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের পর হতেই দ্বীনী জ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল মদিনা।
সে মদিনাতে জন্মগ্রহণ করার অর্থ হল দ্বীনী জ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্রেই জন্ম লাভ করা।
ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ মদিনা শরীফের আলোকিত ও আধ্যাত্মিক পরিবেশে তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছেন। যখন তিনি জ্ঞান অর্জন শুরু করেন, তখন মদিনা মুনাওয়ারা কুরআন ও হাদিসের শিক্ষা দ্বারা প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। আকাবির তাবেঈনের বিভিন্ন শিক্ষামূলক মজলিস মসজিদে নববী ও অন্যান্য স্থানে চালু ছিল, এবং ইলমে নবুয়ত থেকে উৎসারিত জ্ঞানের ধারাগুলি সর্বত্র প্রবাহিত হচ্ছিল। ইমাম মালিক এই জ্ঞানের মজলিসগুলি থেকে সম্পূর্ণভাবে উপকৃত হন এবং তিনি জ্ঞানের রত্নগুলি দিয়ে তাঁর ঝুলি পূর্ণ করেন।
ইমাম সাহেব সতেরো বছর বয়সেই নাফি মাওলা উমর, সাঈদ আল-মুকবুরি, ইবন শিহাব যুহরি এবং ইবন দিনার এর মত বিশিষ্ট আলেমদের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, এবং একুশ বছর বয়সে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠদান এবং ফতোয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আলেম এবং ছাত্ররা তিনার নিকটে শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্য আসতে প্রারম্ভ করেন। এই ধারাবাহিকতা আবু জাফর আল-মানসুরের খেলাফত থেকে শুরু করে হারুন আল-রশিদের যুগ পর্যন্ত চলতে থাকে এবং তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
ইমাম মালিকের পক্ষ থেকে জ্ঞান অর্জন বা শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে কোনো ভ্রমণের কথা বর্ণিত নেই। তিনি সারা জীবন মদিনাতুল মুনাওয়ারাতেই অবস্থান করেছেন, কেবলমাত্র হজের উদ্দেশ্যে মক্কা মুকাররমায় গেছেন, তবে এর বাইরে কোথাও যাননি। এমনকি একবার খলিফা মাহদী তাকে বাগদাদ নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি নিম্নলিখিত হাদিস পড়ে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন:
"الْمَدِينَةُ خَيْرٌ لَهُمْ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ"
অনুবাদ: মদীনা তাদের জন্য মঙ্গলজনক, যদি তারা জানত। (সহিহ বুখারী, হাদীস নং: ১৮৭৫)
মুহাদ্দিসদের প্রথম স্তরে ইমাম মালিককে একটি বিশেষ স্থান দেওয়া হয়েছে, যার স্বীকৃতি ইসলামী বিশ্বের মহান পণ্ডিতরা আন্তরিকভাবে করেছেন। বিশেষজ্ঞদের প্রশংসা যদি শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হয়, তবে বলা যায় যে ইমাম মালিক সেই মানদণ্ডের ভিত্তিতে অত্যন্ত উচ্চ ও সম্মানিত স্থান অধিকার করেছেন যদিও ইমাম মালিক মুহাদ্দিসদের মধ্যে আহলে রায়ের অন্তর্ভুক্ত, আর সাধারণত আহলে রায় মুহাদ্দিসদের কৃতিত্বকে কমই স্বীকার করা হয়, তবুও ইমাম মালিক তাঁদের মধ্যে ব্যতিক্রম। তিনাকে ইলমে হাদীসে যে উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তার কারণ হল, তিনি প্রত্যেক মুহাদ্দিসদের নিকট হতে হাদিস গ্রহণ করতেন না। বরং তিনি কেবল সেই শায়খদের নিকট থেকে হাদিস গ্রহণ করতেন, যাঁরা সত্যনিষ্ঠ, ধার্মিক, হাদিস সংরক্ষণে দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য, এবং দ্বীনের গভীর জ্ঞান রাখতেন, যাঁদের পাণ্ডিত্য ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি তাঁর পূর্ণ আস্থা ছিল।
ইমাম মালিকের শিক্ষক বৃন্দ :
ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ অসংখ্য বিদ্বানের নিকট হতে শিক্ষা লাভ করেন। ইমাম যুরকানী আলাইহির রহমা বলেন ইমাম মালিক নয়শত এর অধিক শিক্ষকের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন।
(শারহুর যুরকানী প্রথম খন্ড পৃষ্ঠা নম্বর ৩৫)
তাদের মধ্যে কিছু প্রমুখ হলেন
১: ইমাম রাবিয়া বিন আবু আব্দুর রহমান।
২: ইমাম মোহাম্মদ বিন মুসলিম আয যহুরী।
৩: ইমাম নাফি মাওলা ইবনু ওমর।
৪: ইব্রাহিম বিন উকবাহ।
৫: ইসমাইল বিন মুহাম্মদ বিন সা'দ।
৬: হুমায়াদ বিন কায়স আল আরজ।
৭: আইয়ুব বিন আবী তামীমাহ আসসখাতিয়ানী
রাহিমাহুমুল্লাহ তায়ালা।
শিক্ষাদান:
হযরত সাইয়্যেদুনা ইমাম মালিক রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ১৭ বছর বয়সে ইলমের আসনে আসীন হন।
আপনার শিক্ষকগণও সমস্যার সমাধানের জন্য তিনার নিকটে আসতেন। তিনি প্রায় ৭০ বছর যাবত ফতোয়া লিখেছেন এবং মানুষকে দ্বীনের জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন।
মর্যাদাশালী ও সম্মানিত তাবেয়ীনে কেরামগণও তিনার নিকট থেকে ফিক্বহ ও হাদিসের জ্ঞান অর্জন করতেন।
(সেয়ারে আলামুন নোবালা, সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা-২৮৭ )
হজরত সাইয়্যেদুনা ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ যখন হাদিস পরিবেশন করার জন্য বসতেন, তার পূর্বে তিনি প্রথমে গোসল করতেন। তিনার জন্য একটি আসন বিছানো হতো এবং তিনি পবিত্র পোশাক পরিধান করতেন এবং সুগন্ধি ব্যবহার করে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে নিজের পবিত্র কক্ষ থেকে বের হয়ে আদব সহকারে সেই আসনের উপর বসতেন। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সেই দ্বীনি সমাবেশে হাদিস পড়ানো হতো, সুগন্ধি ধূপ জ্বলতে থাকত।
(বুসতানুল মুহাদ্দিসইন পৃষ্ঠা: ১৯,২০)
ইমাম মালিকের ছাত্র বৃন্দ:
ইমামে মালিক ছিলেন ইমামু দারিল হিজরাহ, অর্থাৎ মদিনার ইমাম। আর মদিনার ইমামের ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য কে না চায়। তিনার যুগে সারা বিশ্ব থেকে জ্ঞানপিপাসু ছাত্ররা তিনার নিকট হাদিস ও ফিকহের জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে ভিড় জমাতেন,তাই তিনার ছাত্র সংখ্যা অগণিত। ইমাম খাতীব বাগদাদী উল্লেখযোগ্য ৯৯৩ জন উল্লেখ করেন।
(তারতিবুল মাদারিক প্রথম খন্ড পৃষ্ঠা নাম্বার ২৫৪)
ইমামের প্রসিদ্ধ কিছু ছাত্রের নাম নিম্নে প্রদত্ত হলো
১: মোহাম্মদ বিন ইদ্রিস ইমাম শাফেয়ী
২: ইমাম সুফিয়ান বিন উয়াইনাহ
৩: ইমাম আব্দুল্লাহ বিন মুবারক
৪: ইমাম আবু দাউদ অত্তায়ালিসী
৫: হাম্মাদ বিন যায়েদ
৬: ইসমাইল বিন জাফর
৭: ইবনে আবী আযযিনাদ রাহিমাহুমুল্লাহ ইত্যাদি।
ইমামে মালিকের ইবাদত ও উপাসনা:
ইমামে মালিকের সাহেবজাদি(কন্যা)
ফাতিমা বিনতে মালিক,বলেন: ইমাম মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রতি রাতে অজিফা সমূহ (যিকর ও আযকার ) সম্পূর্ণ করতেন এবং যখন শুক্রবারের রাত আসত, তখন তিনি সারা রাত আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকতেন।
হযরত সাইয়্যিদিনা মুগীরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একদা লোকেরা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আমি হযরত সাইয়্যেদুনা ইমাম মালিক বিন আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাড়ির পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করছিলাম এবং আমি তাঁকে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে দেখেলাম। সূরা আল-ফাতিহা, সম্পূর্ণ করার পর সূরা আত্তাকাসুর প্রারম্ভ করলেন যখন ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন
ثُمَّ لَتُسۡـَٔلُنَّ یَوۡمَئِذٍ عَنِ النَّعِیۡمِ
অনুবাদঃ অতঃপর নিশ্চয় নিশ্চয় সেদিন তোমাদেরকে নি য়ামিত সমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।
(পারা নং ৩০, সূরা আত্তাকাসুর , আয়াত নং ৮)
অতঃপর তিনি
অনেকক্ষণ ক্রন্দন করতে থাকলেন। আমি তাঁর তিলাওয়াত শুনে মগ্ন হলাম এবং সেখানে দাঁড়ালাম, তিনি একই আয়াতটি পুনরাবৃত্তি করলেন এবং কাঁদলেন, যতক্ষণ না ভোর হল, তারপর তিনি রুকু করলেন। আমি আমার বাসা থেকে রওনা হলাম, ওযু করে মসজিদে আসলাম দিয়ে দেখলাম মসজিদে দ্বীনি জ্ঞানের সমাবেশ হচ্ছে, চারিদিকে মানুষ ইমাম মালিককে ঘীরে বসে আছেন এবং আপনার চেহারা থেকে নূর চমকাচ্ছে।
হযরত ইবনে ওহাব রাহিমাহুল্লাহ বলেন: আমি সায়্যিদুনা ইমামে মালিকের চাইতে অধিক মুত্তাকী(খোদাভীরু) ও পরহেজগার কাউকে দেখিনি।
মুয়াত্তা ইমাম মালিক:
বিভিন্ন সময়ে হাদিসের বিভিন্ন গ্রন্থ সংকলিত ও সম্পাদিত হয়েছে, তবে "মুআত্তা ইমামে মালিক" হাদিসের সংকলন ধারায় প্রথম গ্রন্থ হিসেবে সম্মানিত হয়েছে। অধিকাংশ ইমাম "মুআত্তা ইমামে মালিক" কে হাদিসের গ্রন্থগুলির মধ্যে প্রথম শ্রেণীর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন:
"ما نعرف کتابا فی الاسلام بعد کتاب اللہ عزوجل اصح من موطأ مالک"
অর্থাৎ "কিতাবুল্লাহ" (আল্লাহর কিতাব) এর পরে আমি ইসলামে মুআত্তা মালিক এর চেয়ে অধিক সহীহ কোনো গ্রন্থ সমন্বে জানি না।
( মানাকিবুশ শাফেয়ী লিল বায়হাকি, ১/৫০৭, আল-মাজরুহিন, ১/৪২)
ইমামগন বলেন যে, ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহ এর এই কথা সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের সংকলনের পূর্বের সময়ের। কারণ, এ ব্যাপারে সমগ্র উম্মাহ ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে কিতাবুল্লাহ (পবিত্র কুরআন) এর পরে সবচেয়ে সহীহ গ্রন্থ হলো সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম। তবে, ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহ এর ইবারাত থেকে মুআত্তা ইমাম মালিকের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়।
হুজ্জাতুল হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রাহিমাহুল্লাহ বলেন: "আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে, ফিক্বহের গ্রন্থসমূহের মধ্যে মুআত্তা ইমাম মালিকের সমপর্যায়ের কোনো গ্রন্থ নেই। কারণ একটি গ্রন্থের শ্রেষ্ঠত্বের কিছু মানদণ্ড রয়েছে, যেমন এর লেখক একজন মহান ব্যক্তিত্ব হওয়া, অথবা গ্রন্থের বিশুদ্ধতার উপর জোর দেওয়া, কিংবা এর হাদিসসমূহ প্রসিদ্ধ হওয়া, অথবা সাধারণ মুসলিম সমাজে এর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা থাকা, অথবা এতে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যসমূহের পরিপূর্ণতা থাকা ইত্যাদি। এই যত গুণাবলি আছে, তা মুআত্তায় পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান।"
(আল-মুসাওয়া লি ওলিউল্লাহ দেহলভি" পৃষ্ঠা নং ১৭)
ইমাম মালিক "মুআত্তা" সংকলন ও বিন্যাসে ৪০ বছর ব্যয় করেছেন। শুরুর দিকে "মুআত্তা" গ্রন্থে ১০,০০০ হাদীস অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে বারবার পর্যালোচনা ও সংহারের সময়, ইমাম মালিকের সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশুদ্ধতা-প্রিয়তার কারণে তিনি ৮,০০০ হাদীস খারিজ করে দেন। অবশেষে "মুআত্তা" গ্রন্থে ১৭২০টি হাদীস অবশিষ্ট রয়ে যায়।
(আল হাদিস ওয়াল মুহাদ্দিসুন পৃষ্ঠা নম্বর ২৪৯)
মালিকী মাযহাব:
আহলে সুন্নাতের ফিক্বহের চার মাযহাবের মধ্যে মালিকী মাযহাব একটি অন্যতম ও অনুসৃত একটি মাযহাব, এই মাযহাব মূলত হিজাজ অঞ্চলে, বিশেষ করে মদিনায় প্রসার লাভ করে। ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ বিশ্বাস করতেন যে ইসলামী আইনের মূল ভিত্তি হবে কুরআন ও হাদিস, এবং বিশেষ করে তিনি মদিনার প্রচলিত প্রথা ও রীতি-নীতি থেকে ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা বের করার উপর জোর দেন। তাঁর বিচারধারার ভিত্তিতে মালিকী মাযহাব গড়ে ওঠে, যা আজও আফ্রিকার বিভিন্ন অংশ, মিশর এবং মাগরিব অঞ্চলে জনপ্রিয়। তাঁর বিচার ও সিদ্ধান্তগুলো আজও মুসলিম বিশ্বের বহু স্থানে আইনের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
যার অনুসারীর সংখ্যা শাফিঈ মাযহাবের অনুসারীর সংখ্যার সাথে তুলনীয়। তবে এটি হানাফী মাযহাবের অনুসারীদের তুলনায় কম । মালিকী চিন্তাগোষ্ঠীভিত্তিক ইসলামী আইনশাস্ত্র মূলত উত্তর আফ্রিকা (আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো, লিবিয়া, তবে উত্তর ও পূর্ব মিশর বাদে), পশ্চিম আফ্রিকা, মধ্য আফ্রিকার চাদ ও সুদান, পশ্চিম এশিয়ার কুয়েত, বাহরাইন, কাতার, দুবাই আমিরাত (সংযুক্ত আরব আমিরাত) এবং সৌদি আরবের উত্তর-পূর্ব অংশগুলিতে আধিপত্য বিস্তার করে আছে।
"মালিকী মাযহাবের প্রচারক প্রকাশকগণের মধ্যে কিছু প্রমুখ ইমাম:
১: আব্দুল্লাহ বিন ওহাব (১২৫-১৯৭ হিঃ)
২: ইমাম আব্দুর রহমান বিন কাসিম
৩: ইমাম আসাহাব বিন আব্দুল আযিয
৪: ইমাম আসাদ বিন ফুরাত বিন সিনান
৫: আব্দুল আযিয বিন মাজশুন
৬: ইমাম ইহয়া বিনি ইয়াহিয়া মাসমোদী আন্দুলসী রাহিমাহুমুল্লাহ ইত্যাদি।
ইন্তেকাল:
ইমাম মালিক রহমাতুল্লাহি আলাইহি ১৪ রবিউল আওয়াল ১৭৯ হিজরিতে, অর্থাৎ ৭ জুন ৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় ইন্তেকাল করেন এবং মসজিদে নববীর সামনে জান্নাতুল বাক্বীতে সমাহিত হন। যদিও মধ্যযুগের শেষের দিকে তাঁর সম্মানের জন্য সেখানে একটি ছোট মাজার নির্মাণ করা হয়েছিল, যেখানে অনেক মুসলিম তাঁর উপস্থিতি কামনা করতেন, কিন্তু সৌদি আরবের রাজতন্ত্র ঐতিহ্যগত ইসলামিক ঐতিহ্যের অনেক কিছু ধ্বংস করার সময় এই নির্মাণটিও ধ্বংস করে দেয়।
উপসংহার:
ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ ইসলামী ফিক্বহ এবং হাদিস শাস্ত্রে এক অনন্য অবদান রেখেছেন। তাঁর জীবন ও কর্ম মুসলিম উম্মাহর জন্য চিরন্তন শিক্ষার উৎস। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মালিকী মাযহাব এবং লেখা "আল-মুআত্তা" আজও ইসলামী জ্ঞান এবং আইন শাস্ত্রে অন্যতম প্রধান রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাঁর কর্ম, শিক্ষা এবং জীবন মুসলিম সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
Comments -