হুযূর আলা হযরতের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
হুযূর আলা হযরতের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
মুফতী শামসুদ্দোহা মিসবাহী
ফলতা, দঃ২৪পরগনা, পঃবঃ
মহান আল্লাহ তা'আলা মানব জাতির কল্যাণার্থে ও তার গন্তব্যস্থলের পথ অতিক্রম করার জন্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় শিক্ষা-দীক্ষা প্রদানার্থে ও তাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে অসংখ্য নবী ও রসূলগণকে এই ধরার বুকে প্রেরণ করেছেন অবশেষে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সর্বশেষ নবী করে পাঠিয়ে নবুওয়াতের দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন কিন্তু নবী ও রসূলগণদের মহান কাজ ও তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার জন্য আউলিয়ায়ে কেরামদের দল কে বেছে নিয়েছেন যাহারা কখনো সাহাবী রূপে আবার কখনো তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ী রুপে,ও কখনো মুজাদ্দিদ, ওলী ও আল্লাহর নেক বান্দার রূপে সেই মহান দায়িত্ব কে নবুওয়াতের দরজা বন্ধ হওয়া থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত খুব সুন্দরভাবে পালন করে আসছেন তন্মধ্যেই অন্যতম ব্যক্তিত্ব হযরত ইমাম আহমদ রেযা খাঁন রাহমাতুল্লাহ আলাইহির যিনি সবার মাঝে আলা হযরত নামে প্রসিদ্ধ ও পরিচিত । তিনি চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, বড় আলিমে দ্বীন, মুফতী , মুহাদ্দিস, মুফাসসির,মুনাযীর, দার্শনিক, সাহিত্যিক, ভাষাবিদ, কবি ,কলম সম্রাট,বহু সুন্নত জীবিতকারী ও বহু বিদাতের বিনাশকারীর সঙ্গে সঙ্গে বহু পুস্তকের লেখক গবেষক ও একজন আল্লার নৈকট তো লাভকারী বান্দা ও ওলী ছিলেন। এই লেখনীর মাধ্যমে তাঁরই সংক্ষিপ্ত জীবন সম্পর্কে অবগত হব ইনশাআল্লাহ ।
শুভ জন্ম: আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খাঁন রাহমাতুল্লাহ আলাইহি ১০ই শাওয়াল ১২৭২ হিজরী, ১৪ই জুন ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দ রোজ শনিবার ভারতের ( ইউপি) বেরেলী শহরের যাসুলি নাম মহল্লায় যোহরের সময় জন্মগ্রহণ করেন। জন্ম বৎসর হিসাবে তার ঐতিহাসিক নাম আল মুখতার (১২৭২ হি:)
তিনি পবিত্র কোরআন মাজীদের 2৮ পারা সূরাতুল মুজাদালার ২২ নম্বর আয়াত ("
أُولَئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الإيمَانَ وَأَيَّدَهُمْ بِرُوحٍ مِنْهُ
অনুবাদ: এরা ঐসব লোক যাদের অন্তরগুলিতে আল্লাহ ঈমান অংকিত করে দিয়েছেন এবং তার নিকট থেকে রুহ দ্বারা তাঁদের সাহায্য করেছেন।) থেকে আরবি সংখ্যাতাত্বিক গাণিতিক সূত্রের মাধ্যমে ( ইলমে আবজাদ ) স্বীয় জন্ম সাল ১২৭২ হিজরী বের করেছেন।
বংশ পরিচয়: আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খাঁন রাহমাতুল্লাহ আলাইহির পিতার নাম মাওলানা নাক্বি আলি খাঁন রাহমাতুল্লাহ আলাইহি যিনি নিজের যুগের বিখ্যাত একজন আলীমের দ্বীন গবেষণা ও বহু পুস্তকের প্রণেতা ছিলেন এবং আলা হযরতে দাদার নাম মাওলানা রেজা আলী খাঁন রহমাতুল্লাহ আলাইহি তিনি একজন বড় আলিমে দ্বীন ছিলেন। আলা হযরতের বংশের পূর্বপুরুষগণ আফগানিস্তান কান্দাহারের এক সম্মানীয় গোত্র বাড়াইচের পাঠান ছিলেন। তন্মধ্যে একজন পূর্বপুরুষ জনাব শাহ সাইদুল্লাহ খাঁন মোগল আমলে প্রথমে করাচি ভয়ে দিল্লি ও তারপর বেরেলী শহরে আসেন পরে এখানকার বাসিন্দা হয়েই থেকে যান ।
নাম করণ আলা হযরত রহমাতুল্লাহ আলাইহির ঐতিহাসিক নাম আল মুখতার(১২৭২হিঃ) এবং তাঁর পিতামহ হযরত মাওলানা রেযা আলি খাঁন তাঁর নাম মোহাম্মদ আহমদ রেযা খাঁন রাখেন। তার মহিয়সী মাতা পরম স্নেহের সাথে ডাকতেন আমান মিয়া ও পিতা ডাকতেন আহমদ মিয়া বলে। রাসুল প্রেমের নিদর্শন স্বরূপ তিনি নিজের নামের পূর্বে আব্দুল মোস্তফা সংযোজন করতেন।
শিক্ষাগত যোগ্যতা তিনি ১২৭৬ হিজরী অনুযায়ী ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র চার বছর বয়সে পবিত্র কোরআন শরীফ নাজরা সম্পূর্ণ করেন । এরপর প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন তাঁর সম্মানীয় পিতা তত্ত্ববোধনেই । এছাড়া যে সকল শিক্ষকগণের কাছ থেকে তিনি শিক্ষা অর্জন করেছিলেন তন্মধ্যে মাওলানা আব্দুল আলীম রামপুরী
ও মাওলানা মির্জা গোলাম বেগ প্রমুখ অন্যতম ।
১২ই রবিউল আউয়াল ১২৭৮ হিজরী পবিত্র জাশনে ঈদ মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) উপলক্ষে আয়োজিত মহাসমাবেশে এক হৃদয়গ্ৰাহী বক্তৃতা দিয়ে সকল আলোচক ও শ্রোতাকে হতবাক করে দেন। ৮ বছর বয়সেই আরবি ব্যাকরণের বিখ্যাত গ্রন্থ হেদায়াতুন্নুহ পাঠ সমাপ্ত করেন এবং আরবিতে তার একটি শারাহ (ব্যাখ্যা) ও লেখেন। এই হিসাবে এটাই তার সর্বপ্রথম লিখিত পুস্তক। আরো বিস্ময়ের বিষয় হলো মাত্র ১৩ বছর ১০ মাস ৪ দিন বয়সে তিনি সর্ববিষয়ে জ্ঞান লাভ করে ১২৮৬ হিজরী ১৮ ৬৯ খ্রিস্টাব্দে ১৪ই সাবান দস্তারে ফজিলত লাভ করেন। আরো আশ্চর্যের বিষয় যে যে দিনে তিনি শেষ বর্ষ সনদ লাভ করে সেদিনই তিনি বালক হন এবং সেদিনেই তিনি স্তন্যদান সম্পর্কিত একটি জটিল বিষয়ে ফতোয়া প্রদান করেন। ফতোয়া প্রদানে তাঁর এই দক্ষতার পরিচয় পেয়ে তাঁর পিতা মওলানা নাক্বি আলী খাঁন ফতোয়া প্রদানের দায়িত্ব তাঁকে দিয়ে দেন ।
গণিত শাস্ত্রে আ'লা হযরতের পারদর্শিতা
আল্লাহ তা'আলা তাকে অসামান্য জ্ঞানের অধিকারী করেছিলেন। তিনি কমবেশি ৫০ টির অধিক বিষয়ে কলম ধরেছেন এবং নামিদামি পুস্তক রচনা করেছেন। প্রতিটি শাস্ত্রে তিনি দক্ষ ও পারদর্শী ছিলেন। সময় নির্ণয় বিদ্যায় তিনি এতই পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন যে, দিনের বেলায় সূর্য এবং রাত্রি বেলায় নক্ষত্র দেখে তিনি নির্ভুলভাবে সময় নিরূপণ করতে পারতেন। এতে কখনও এক মিনিটেরও কমবেশী হত না। গণিত শাস্ত্রে তিনি অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। কথিত আছে যে, আলিগড় বিশ্ব বিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর জিয়া উদ্দিন, যিনি গণিত শাস্ত্রে বিদেশী ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন এবং স্বর্ণ পদকও লাভ করেছিলেন। একদা কোন এক গাণিতিক সমস্যার সমাধানের জন্য আ'লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলাইহির দরবারে হাজির হন। আ'লা হযরত তাঁকে বললেন: "আপনার প্রশ্নটা বলুন।" তিনি বললেন: "প্রশ্নটা এতই জটিল যে, এ অবস্থায় সহজভাবে তা বলা যাবে না।" আ'লা হযরত রাহমাতুল্লাহ আলাইহি তখন বললেন: “তাহলে বিস্তারিতভাবেই বলুন।" ভাইস চ্যান্সেলর সাহেব আ'লা হযরত কে প্রশ্নটা বিস্তারিত বললেন। প্রশ্নটা শুনে আ'লা হযরত সাথে সাথেই তার সন্তোষ জনক উত্তর দিয়ে দিলেন। তাঁর উত্তর শুনে ভাইস চ্যান্সেলর সাহেব কিছুক্ষণ অবাক হয়ে রইলেন। তারপর তাঁকে বললেন: “হযরত! আমি এ প্রশ্নের সমাধানের জন্য জার্মান যেতে ইচ্ছা করেছিলাম, কিন্তু একজন আপনার নিকট আসতে বলাই আমি আসলাম আপনার উত্তর শুনে মনে হচ্ছে, আপনি সমস্যাটার সমাধান যেন বইতে নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছেন।"তাঁর এই জ্ঞানের গভীরতা ও ব্যক্তিত্বে তিনি এতই মুগ্ধ হয়ে গেলেন যে, মুখে দাড়ি রেখে দিলেন এবং নামায রোযার অনুসারী হয়ে যান।
এক মাসে পবিত্র কোরআন শরীফ মুখস্থ
হযরত সায়্যিদ আইয়ুব আলী সাহেব বর্ণনা করেন:
"একদিন আ'লা হযরত বলেন: "আমার সম্পর্কে কিছু অনবহিত লোক আমার নামের আগে হাফেজ লিখে থাকেন, অথচ আমি পবিত্র কুরআনের হাফেজ নই।" তিনি আরও বর্ণনা করেন, "যেদিন আ'লা হযরত এ কথা বলেছেন: সেদিন থেকে তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্থ করা শুরু করে দেন এবং ইশার নামাযের জন্য অযু করার পর থেকে জামাআত শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি কুরআন শরীফ মুখস্থ করার জন্য সময় নির্ধারণ করে নেন।
এভাবে তিনি দৈনিক এক পারা করে মাত্র ত্রিশ দিনে ত্রিশ পারা কুরআন শরীফ হিফজ করা শেষ করেন। এক জায়গায় তিনি বলেন যে, আমি কুরআন শরীফ ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে মুখস্থ করি আর তা এজন্য যে, ঐসব আল্লাহর বান্দার কথা (যারা আমার নামের আগে হাফেজ লিখে দেয়) যেন ভুল প্রমাণিত না হয়।
রসুলের প্রতি অগাধ ভালবাসা
আলা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জান-প্রাণ দিয়ে খুবই ভালোবাসতেন তুমি বলতেন যদি কেউ আমার কলিজাকে দুই টুকরো করে দেয় তাহলে এক টুকরো তে(لا الله الا الله (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ আর অপর টুকরোতে( محمد رسول الله ) মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম) লিখিত পাবে । প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসায় লেখা তাঁর কাব্যগ্রন্থে হাদায়েকে বখশিশ প্রতিটি চরণ রসুলের প্রতি তাঁর নজিরবিহীন অগাধ ভালবাসার সাক্ষ্য বহন করে। যা এই সংক্ষিপ্ত লেখনীর মাধ্যমে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
রচনাবলী
আলা হযরত রহমাতুল্লাহ আলাইহি বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় এক হাজারেরও বেশী কিতাব রচনা করেছেন। তিনি ১২৮৬ হিজরী থেকে ১৩৪০ হিজরী পর্যন্ত লাখো ফতোয়া দিয়েছেন। কিন্তু আফসোস! তাঁর লিখিত সমস্ত ফতোয়া গ্রন্থাকারে এখনো ছাপা হয়নি। আর যেগুলো গ্রন্থাকারে ছাপা হয়েছে, তার নামকরণ করা
الْعَطَايَا النَّبَوِيهِ فِي الفَتَاوَى الرَّضَوِيَّة " : ( আল আতায়ান নাবাবিয়্যাহ ফিল ফাতায়ার রাযাবিয়্যাহ)
তাঁর লিখিত ফতোয়ায়ে রাযাবিয়্যাহ (নতুন সংস্করণ) ৩০ খন্ড, যার সর্বমোট পৃষ্ঠা : ২১৬৫৬, সর্বমোট প্রশ্ন-উত্তর ৬৮৪৭টি , ও সর্বমোট রিসালা হল ২০৭ টি।তিনি তাঁর লিখিত প্রতিটি ফতোয়াকে কুরআন হাদীসের অগণিত দলিল দ্বারা প্রমাণ করেছেন। কুরআন, হাদীস, ফিকাহ, মানতিক ও ইলমে কালাম ইত্যাদিতে তিনি যে অসীম জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, তা তাঁর লিখিত ফতোয়া পড়লে সহজেই অনুধাবন করা যায়।
কোরআন শরীফের অনুবাদ
আলা হযরত রহমাতুল্লাহ আলাইহি কোরআন শরীফের যে অনুবাদ উর্দু ভাষায় করেছেন তা বর্তমানে সময়ে উর্দু ভাষার সমস্ত অনুবাদের থেকে ভিন্ন ও শীর্ষস্থান অধিকারকারী যার নাম কানযুল ঈমান রেখেছেন ।তাঁর বিশিষ্ট খলিফা, সদরুল আফাযিল মাওলানা সায়্যিদ মুহাম্মদ নঈম উদ্দীন মুরাদাবাদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি "খাযায়েনুল ইরফান" নামে এবং প্রসিদ্ধ মুফাসসির হাকীমুল উম্মত হযরত মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন রাহমাতুল্লাহ আলাইহি "নূরুল ইরফান" নামে প্রান্ত টিকা লিখেছেন।
ইন্তেকাল
আ'লা হযরত রহমাতুল্লাহ আলাইহি তাঁর ইন্তিকালের চার মাস বাইশদিন পূর্বে তাঁর ইন্তিকালের সংবাদ দিয়ে পবিত্র কুরআনের ২৯ পারার সূরা দাহরের ১৫নং আয়াত وَيُطَافُ عَلَيْهِمْ بِآنِيَةٍ مِنْ فِضَّةٍ وَأَكْوَابٍ ( আর (সেবকগণ কর্তৃক) তাদেরকে ঘুরে ঘুরে পরিবেশন করা হবে রৌপ্যের পাত্রে এবং (পরিচ্ছন্ন) স্ফটিকের পানপাত্রে) থেকে তাঁর ইন্তিকালের বছর বের করেন। সে আয়াতটির ইল্মে আবজদ অনুসারে সংখ্যা হয় ১৩৪০।
২৫ শে সফর ১৩৪০ হিজরী অনুযায়ী ২৮শে অক্টোবর ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ রোজ জুমাবার ভারতীয় সময় বেলা ২টা ৩৮ মিনিটে ঠিক জুমার আযানের সময়,ইমামে আহলে সুন্নাত, শাহ্ ইমাম আহমদ রযা খাঁন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এ নশ্বর জগত ত্যাগ করে মহান আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন।
: إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ
তাঁর নূরানী মাজার শরীফ বর্তমানে বেরেলী শরীফে অবস্থিত। যা এখনও পর্যন্ত তাঁর ভক্ত অনুরক্তদের জেয়ারত গাহ ও সমাগমে পরিণত হয়ে আছে। আল্লাহ তাআলার রহমত তাঁর উপর বর্ষিত হোক, আর তাঁর সদকায় আল্লাহ আমাদের বিনা হিসাবে ক্ষমা করুক ।
آمين بجاه النبي الأمين صلى الله تَعَالَ عَلَيْهِ وَالِهِ وَسلم |
Comments -