মহরম মাসের ফজিলত, করণীয় ও বর্জনীয়
মহরম মাসের ফজিলত, করণীয় ও বর্জনীয়
ক্বারী নুর মুহাম্মদ, বীরভূম
দিবস হলো আশুরা, যাকে আমরা বাংলাতে ১০ই মুহাররম বলি।
কুরআন শরীফে বর্ণিত চারটি মর্যাদার মাসের মধ্যে একটি অন্যতম মাস। এ চারটি মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহসহ সবরকম পাপাচার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে কুরআন শরীফে ।
আল্লাহ্ তাআলা বলেন:
اِنَّ عِدَّةَ الشُّهُوْرِ عِنْدَ اللّٰهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِیْ كِتٰبِ اللّٰهِ یَوْمَ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ مِنْهَاۤ اَرْبَعَةٌ حُرُمٌؕ-ذٰلِكَ الدِّیْنُ الْقَیِّمُ فَلَا تَظْلِمُوْا فِیْهِنَّ اَنْفُسَكُمْ وَ قَاتِلُوا الْمُشْرِكِیْنَ كَآفَّةً كَمَا یُقَاتِلُوْنَكُمْ كَآفَّةًؕ-وَ اعْلَمُوْۤا اَنَّ اللّٰهَ مَعَ الْمُتَّقِیْنَ(36)
অনুবাদ: নিশ্চয়ই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে আল্লাহর বিধানে মাস গণনায় বারটি। এর মধ্যে বিশেষ রূপে চারটি মাস হচ্ছে সম্মানিত। এটাই হচ্ছে সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্ম। অতএব তোমরা এ মাসগুলিতে (ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করে) নিজেদের ক্ষতি সাধন করনা, আর মুশরিকদের বিরুদ্ধে সকলে একযোগে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সকলে একযোগে যুদ্ধ করে। আর জেনে রেখ যে, আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে রয়েছেন। (সূরা আত-তাওবাহ-৩৬)
আয়াতের ব্যাখ্যা : তাফসীর বিশারদগণ বলেছেন, অত্যাচার বলতে এখানে যে কোনো ধরণের পাপাচার করাকে বুঝানো হয়েছে। তাই এ মাসে পাপাচার না করাই সেরা অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আমল।
এমনিতে অন্যান্য মাসে গুনাহের কাজ করা মুমিন মুসলমানের জন্য জঘন্য কাজ। আর সম্মানিত চার মাস জিলক্বদ, জিলহজ্ব, মহররম ও রজব মাসে পাপাচার করা দ্বিগুণ মারাত্মক অন্যায় ও সরাসরি মহান আল্লাহর নির্দেশের লঙ্ঘন।
নিম্নে এই মাসের করণীয় ও বর্জনীয় তুলে ধরা হলো—
করণীয় ও বর্জনীয়: মাতম-মর্সিয়া পরিহার করা : ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাতকে কেন্দ্র করে আশুরা নিয়ে বেশ বাড়াবাড়ি রয়েছে তার সঙ্গে আছে অনেক কুসংস্কার তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো মাতম মর্সিয়া গাওয়া।
মাতম মর্সিয়া মানে হলো: নিজের দেহ কে আঘাত করা নিজের পোশাক আশাক ছিঁড়ে ফেলা । আর ইসলামে এটি নিষিদ্ধ ।
হাদীস শরীফে এসেছে:
عَنْ عَبْدِ اللهِ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُودَ وَشَقَّ الْجُيُوبَ وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ
অনুবাদ: হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনু মাস‘ঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: যারা শোকে গন্ডে চপেটাঘাত করে, জামার বক্ষ ছিন্ন করে ও জাহিলী যুগের মত চিৎকার দেয়, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়। (সহীহ মুসলিম হাদীস নং ১০৩)
যুদ্ধ সরঞ্জামে সজ্জিত হয়ে ঘোড়া নিয়ে প্রদর্শনী করা থেকে বিরত থাকা।
হায় হুসেন, হায় আলি ইত্যাদি বলে বিলাপ, মাতম কিংবা মর্সিয়া ও শোকগাঁথা প্রদর্শনীর সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের বুকে পেটে পিঠে ছুরি মেরে রক্তাক্ত করা থেকেও বিরত থাকা।
👉ফুল দিয়ে সাজানো এসব নকল তাযিয়া বা কবরের বাদ্যযন্ত্রের তালে প্রদর্শনী থেকে বিরত থাকা।
👉হজরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহ আনহুর নামে ছোট বাচ্চাদেরকে ভিক্ষুক বানিয়ে ভিক্ষা করানো। এটা করিয়ে মনে করা যে, ঐ বাচ্চা দীর্ঘায়ু হবে। এটাও মহররম বিষয়ক একটি কু-প্রথাও বটে।
👉আশুরায় শোক প্রকাশের জন্য নির্ধারিত কালো ও সবুজ রঙের বিশেষ পোশাক পরা থেকে বিরত থাকা।
👉 এই দিনটাকে শোকের দিন মনে করা থেকে বিরত থাকা।
✅ আশুরার রোজা রাখা : এ মাসের বিশেষ ফজিলতপূর্ণ দিন হচ্ছে দশম দিন তথা আশুরা। আশুরার রোজা রাখা মুস্তাহাব আমল।
হাদীস শরীফে এসেছে: ইবনে আব্বাস রািয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুল স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা আশুরার দিন (মহররমের দশম দিবস) রোজা রাখো এবং তাতে ইহুদিদের বিরুদ্ধাচরণ করো। আশুরার আগে এক দিন বা পরে এক দিন রোজা রাখো।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২১৫৪)
নফল রোজা রাখা: এই মাসে নফল রোজা রাখা একটি অন্যতম আমল ।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، - رضى الله عنه - قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللَّهِ الْمُحَرَّمُ وَأَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ
অনুবাদ: হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ- রমযানের রোযার পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহাররমের রোজা এবং ফরয নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ হচ্ছে রাতের নামায। (সহীহ মুসলিম হাদীস নং ১১৬৩)
মুহাররম মাসে বিবাহ
মুহাররম মাসেও অন্যান্য মাসের মতো বিয়ে এবং এ ধরনের অন্যান্য বৈধ অনুষ্ঠান করতে কোনো সমস্যা নেই। প্রকৃতপক্ষে, দ্বীন থেকে দূরত্ব এবং শরীয়ত সংক্রান্ত বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে, কিছু লোক এই মাসে বিয়েকে অবৈধ বলে মনে করে এবং কেউ কেউ এমনও বলে যে এটি জায়েজ নয়, যদিও এই জাতীয় জিনিসগুলির সাথে শরীয়তের কোন সম্পর্ক নেই, কারণ ইসলামী শরীয়তে বিবাহ বছরের যে কোন সময় এবং যে কোন দিন করতে পারে
বিয়ে করা নিষেধ নেই, তাই বিয়ে করা জায়েজ, এবং এর জন্য নিম্নোক্ত যুক্তি রয়েছে: (১) মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন:
وَ اَنۡکِحُوا الۡاَیَامٰی مِنۡکُمۡ وَ الصّٰلِحِیۡنَ مِنۡ عِبَادِکُمۡ وَ اِمَآئِکُمۡ ؕ اِنۡ یَّکُوۡنُوۡا فُقَرَآءَ یُغۡنِہِمُ اللّٰہُ مِنۡ فَضۡلِہٖ ؕ وَ اللّٰہُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ ﴿۳۲﴾
অনুবাদ: তোমাদের মধ্যে যারা ‘‘আইয়িম’’ (বিপত্নীক পুরুষ বা বিধবা মহিলা) তাদের বিবাহ সম্পাদন কর এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও। তারা অভাবগ্রস্ত হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দিবেন; আল্লাহ তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সম্পূর্ণভাবে (অর্থাৎ কোনো বাধা ছাড়াই) বিয়ে করার নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি বলেননি যে, অমুক মাসে, অমুক দিনে বিয়ে কর এবং অমুক সময়ে নয়।
(আল নূর, আয়াত (32)
(২) অনুরূপভাবে মহানবীও বিনা বন্দিশালায় বিয়ে করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই তিনি (স্বল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ
يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ
, অনুবাদঃ “হে যুব সমাজ! তোমাদের মধ্যে যে দাম্পত্য জীবনের ব্যয়ভার বহন করতে সক্ষম সে যেন বিবাহ করে। কারণ তা (বিবাহ) দৃষ্টিকে নিচু করে এবং লজ্জাস্থানকে সুরক্ষিত করে।
(সহীহ আল-বুখারী, কিতাবুন-নিকাহ, খণ্ড. 2, পৃ. 758)
যখন মহান আল্লাহ, এবং তাঁর রাসূল, এবং কোন সাহাবী এই বিষয়ে কোন বিধিনিষেধ আরোপ করেননি, তারপর কিভাবে একটি নির্দিষ্ট মাস বা বিশেষ মাসে শরীয়তের নিরঙ্কুশ হুকুমের সাথে নিজের পক্ষ থেকে কেউ নিষেধাজ্ঞা যোগ করতে পারে?
শরীয়তের দ্বারা কোন বিষয়কে যখন মাহমুদ বলা হয়, তখন যেখানেই, যখনই এবং যাই হোক না কেন, একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা না আসা পর্যন্ত তা সর্বদাই মাহমুদ হবে।
(ফাতাওয়া রিজভিয়া, খণ্ড ২৬, পৃ. 528, রাজা ফাউন্ডেশন, লাহোর)
উল্লেখিত যুক্তিগুলো থেকে বোঝা গেল যে, বছরের কোনো মাস বা দিনে বিয়ে করা নিষেধ নেই, তবে কোনো মুসলমান যদি ওই মাসে বিয়েকে জায়েয মনে করে, কিন্তু লোকের কথা এড়াতে সে মাসে বিয়ে থেকে বিরত থাকে তাহলে তাতে কোনো অসুবিধা নেই, তবে শরিয়তের বিষয়টি মানুষকে জানাতে হবে।
বিঃ দ্রঃ- মুহাররম মাসের ১০ তারিখে ইমাম হোসাইন কারবালার প্রান্তরে শহীদ হয়েছিলেন। সুতরাং তাঁর স্মরণে বাড়িতে ফাতিহা করার চেষ্টা করবেন। ইনশাআল্লাহ হযরত ইমাম হুসাইন ও অন্যান্য শোহাদায়ে কারবালার ওসীলায় উপকার পাবেন।
ইন শা আল্লাহ এর সাওয়াব পাবেন।
Comments -