সাহাবায়ে কেরামের সম্মানার্থে কুবাক্য প্রয়োগ কারীর হুকুম
সাহাবায়ে কেরামের সম্মানার্থে কুবাক্য প্রয়োগ কারীর হুকুম
মাওলানা মানিরুল ইসলাম কালিয়াচক, মালদা
শিক্ষক: মাদ্রাসা গাওসিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়াহ হরিবাটি,কুলি, মুর্শিদাবাদ।
প্রশ্ন: সাহাবায়ে কেরামের বিপক্ষে কুবাক্য প্রয়োগকারীর প্রতি কুরআন ও হাদীস এবং ফিক্বহ শাস্ত্রের আলোকে কি হুকুম প্রযোজ্য হবে??
উত্তর: মুসলমানদের উপর সমস্ত সাহাবের কেরামের সম্মান বজায় রাখা অনিবার্য।
কেউ যদি কোন সাহাবির সম্মানার্থে বেয়াদবি করে, গালাগাল করে যদি সে বিষয়টি অকাট্য দলীলের বিরোধী হয় তাহলে কুফরী হবে। অন্যথায় পথভ্রষ্টতা ও পাপাচার।
এ প্রসঙ্গে নিম্নে কিছু দলীল উপস্থাপন করা হলো।
আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনের সুরা ফাতাহ আয়াত নং - ২৯ এর এক অংশে বলেন لیغیظ بھم الکفار ' অর্থাৎ: যাতে তাঁদের (সাহাবীদের) দ্বারা কাফিরদের অন্তর (হিংসার) আগুন জ্বলে।
অতএব: উক্ত আয়াতের আলোকে বুঝা যায়,যে সাহাবীদের প্রতি বিদ্ধেষপূর্ণভাব রাখা কাফিরদের স্বভাব।
এবার আমরা আলোচনা করবো নির্ভরযোগ্য তাফসীরের কিতাব থেকে, তাহলে বিষয়টা আরো পরিস্কার হয়ে যাবে, ইনশা আল্লাহ।
ইমাম হাকিম নেশাপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি, আপন পুস্তকে একটি হাদীস শরীফ আনয়ন করেছেন সেটি নিম্নে দেওয়া হলো:
,عن خیثمة قال :قرأ رجل علی عبد الله رضی الله عنه سورۃ الفتح فلما بلغ کزرع أخرج شطآٔہ فآزرہ فاستغلظ فاستوی علی سوقه یعجب الزراع لیغیظ بھم الکفار (الفتح ) قال :لیغیظ الله بھم الکفار بالنبی صلی الله علیه وسلم و باصحابه الکفار :
অর্থাৎ: হযরত খায়সামা রহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সামনে সূরা ফাতাহ তেলাওয়াত করতে লাগলো , অবশেষে,
کزرع أخرج شطآٔہ فآزرہ فاستغلظ فاستوی علی سوقه یعجب الزراع لیغیظ بھم الکفار ،
এ আয়াত পর্যন্ত পৌঁছলে, তখন তিনি এর ব্যাখ্যায় বললেন, মহান আল্লাহ প্রিয় নবী স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণের সমৃদ্ধি দ্ধারা কাফিরদের অন্তরে জ্বালা সৃষ্টি করেন।(আল মুস্তাদরাক আলাস সাহিহাঈন খন্ড ২ পৃষ্ঠা নং,৫০১ হাদীস নং,৩৭১৮)
ইমাম কুরতুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি
তাফসীরে কুরতুবী খন্ড,১৬, পৃষ্ঠা নং ২৯৭ এর মধ্যে লিখেন:
فقال مالک ، من أصبح من الناس فی قلبه غیظ علی احد من أصحاب رسول اللہ صلی الله علیه وسلم فقد اصابته ھذہ الایة ;;
অর্থাৎ: হযরত মালেক ইবনে আনাস রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ আয়াত প্রসঙ্গে বলেন যে, যে মানুষের অন্তরে আল্লাহর রসূলের সাহাবীদের প্রতি বিদ্ধেষপূর্ণভাব থাকবে তো সে এই আয়াতের আয়ত্বে পড়বে।
ইমাম কিরমিনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি
গারায়েবুত তাফসীর ও গাযায়েবুত তাভীল পৃষ্ঠা নং,১১১৮ এর মধ্যে লিখেন:
قوله :لیغیظ بھم الکفار -ای ضرب ذلک المثل لیغیظ الله بمحمد علیه السلام و اصحابه الکفار ،
অর্থাৎ: এই উপমা টি এই জন্য দেওয়া হয়েছে, যাতে মহান আল্লাহ পাক হযরত মুহাম্মদ স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণের দ্ধারা কাফিরদের অন্তরে জ্বালা সৃষ্টি করেন।
অতএব পবিত্র কুরআন ও তাফসীরের আলোকে প্রমাণিত হলো কাফিরদের স্বভাবই হচ্ছে প্রিয় নবীজির সাহাবীদের সমালোচনা করা।
সাহাবাগণের প্রতি অপবাদের পরিণাম হাদীসের আলোকে:
ইমাম তিরমিযী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি
عن عبدالله بن مغفل قال : قال رسول الله صلی الله علیه وسلم الله الله فی اصحابی لا تتخذوھم غرضا بعدی ,,,,
অর্থাৎ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফ্ফাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ কে ভয় করো, আল্লাহ কে ভয় করো, আমার সাহাবাগণের ব্যাপারে, আমার পরে তাদের সমালোচনাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করোনা।(সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৮৬২
মিশকাতুল মাসাবীহ , হাদীস নং ৬০১৪
মুসনাদে আহমাদ খন্ড ২৭, পৃষ্ঠা নং ৩৫৮, হাদীস নং ১৮৮০৩ )
عن ابی ھریرۃ قال: قال رسول الله صلی الله علیه وسلم لا تسبوا اصحابی لا تسبوا اصحابی فوالذی نفسی بیدہ لو ان احدکم انفق مثل احد ذھبا ما أدرک مد احدکم ولا نصیفه
অনুবাদ: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার সাহাবীগণ কে মন্দ বলবে না, আমার সাহাবীগণ কে মন্দ বলবে না, তোমাদের মধ্য থেকে যদি কেউ কোনো ব্যক্তি উহুদ পর্বতের সমপরিমাণ স্বর্ণ ও (আল্লাহর পথে)ব্যয় করে দেয়, তাহলেও তাদের এক সের (কেজি) পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। আর না অর্ধেক সের (কেজি)(সহি মুসলিম হাদীস নং ২৫৪০
মিশকাতুল মাসাবীহ হাদীস নং ৬০০৭)
عن عویم بن ساعدۃ رضی اللہ عنه ان رسول الله صلی الله علیه وسلم قال: ان الله تبارک وتعالیٰ اختارنی و اختار بي اصحابا فجعل لی منھم وزارء و انصارا و اصھارا فمن سبھم فعلیه لعنة الله والملائکة والناس اجمعین لایقبل منه یوم القیامة صرف ولا عدل
অর্থাৎ: হযরত উআইম ইবনে সায়েদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক আমাকে মনোনীত করেছেন এবং আমার সাহাবীগণ কেও আমার জন্য মনোনীত করেছেন। অতএব, তাদের মধ্য থেকে কাউকে আমার ওযীর (মন্ত্রী) কাউকে আমার সাহায্যকারী এবং আমার শ্বশুরালয়ের দিকের আত্নীয় করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তাদের মন্দ বলে তার ওপর আল্লাহ পাক ও তার ফারিস্তার ও সকল মানুষের অভিশম্পত। কেয়ামতের দিবসে না তাদের কোন ফরজ (আমল) ক্ববুল হবে,আর না কোন নফল।
(আল মুস্তাদরাক আলাস সাহিহাঈন খন্ড,৩ পৃষ্ঠা নং,৭৩২ হাদীস নং ৬৬৫৬)
عن عائشة رضی الله عنها قالت: قال رسول الله صلی الله علیه وسلم: لا تسبوا اصحابی لعن الله من سب اصحابی
অর্থাৎ: হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূল স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা আমার সাহাবীদের কে মন্দ বলো না। যারা আমার সাহাবীগণ কে মন্দ বলে তাদের প্রতি আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক।(মাজমাউয যাওয়ায়েদ,খন্ড,১৬ পৃষ্ঠা,৫৭৭ হাদীস নং,১৬৩৮৬ )
عن ابی سعید قال: قال رسول الله صلی الله علیه وسلم من سب احدا من اصحابی فعلیه لعنة الله
অনুবাদ: হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূল স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোনো সাহাবী কে মন্দ বলবে, তার প্রতি আল্লাহ পাকের লানত বর্ষিত হোক।
(মাজমাউয যাওয়ায়েদ হাদীস নং ১৬৩৮৭ )
সাহাবায়ে কেরামের বিরুদ্ধে কুবাক্য প্রয়োগকারীর ফিক্বহী হুকুম :
واما من سب أحدا من الصحابة فھو فاسق و مبتدع بالاجماع الا اذا اعتقد انه مباح او یترتب علیه ثواب کما علیه بعض الشیعة او اعتقد کفر الصحابة فانه کافر بالاجماع
অর্থাৎ: আর কেউ যদি কোনো সাহাবী কে গালি দেয়, তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে সে ফাসিক ও বিদআতী।তবে কেউ যদি গালি দেওয়াকে বৈধ ও সওয়াবের কাজ মনে করে, যেমনটা কতক শিয়াদের বিশ্বাস অথবা সাহাবীরা কুফরী করেছেন এমন বিশ্বাস রাখে, তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে সে কাফির। (মাজমুয়াতু রসায়েল খন্ড,১ পৃষ্ঠা নং,৩৬৭)
قال مالک بن انس :من تنقص أحدا من أصحاب رسول الله صلی الله علیه وسلم او کان فی قلبه علیھم غل فلیس له حق فی فیئ المسلمین
অর্থাৎ: মালিক ইবনে আনাস রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন,যে ব্যক্তি রসূল স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবাগণের মধ্য হতে কোন সাহাবীর মর্যাদাহানী করল,কিংবা তাদের সম্পর্কে অন্তরে হিংসা পোষণ করল, তাহলে মুসলমানদের সন্ধি সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদে তার কোন অধিকার নেই।(হিলয়াতুল আউলিয়া খন্ড,৬ পৃষ্ঠা নং ৩২৭)
وما أحسن مااستنبط الامام مالک من ھذہ الایة الکریمة ان الرفضی الذی یسب الصحابة لیس له فی مال الفيئ نصیب لعدم اتصافه بما مدح الله به
অর্থাৎ: ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ আয়াতে কারিমা থেকে কতইনা সুন্দর মাসয়ালা উদঘাটন করেছেন যে, নিশ্চয়ই রাফেযী যে মহান সাহাবীগণ কে মন্দ বলে তার জন্য মালে ফাই, তথা সন্ধি সূত্রে প্রাপ্ত কোন অংশ নেই। কেননা মহান আল্লাহ পাক যে প্রশংসা করেছেন তা অস্বীকার করার কারনে।
(তাফসীরে ইবনে কাসীর কন্ড,১৩ পৃষ্ঠা নং,৪৯৩.৪৯৪ )
وسب أصحاب النبی علیه السلام و تنقصھم او احد منھم من الکبائر المحرمة
অর্থাৎ: নবী করীম স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবাগণ কে গালমন্দ করা এবং তাদের সকলের মর্যাদাহীন করা কিংবা যে কোন একজন সাহাবীর ব্যাপারে এরূপ করা কবিরা গুনাহ এবং হারাম। (ইকমালুল মুয়াল্লিম বি ফাওয়ায়িদি মুসলিম, খন্ড,৭ পৃষ্ঠা নং ৫৮০)
শারহে আক্বাঈদ এর মধ্যে রয়েছে-
فسبھم والطعن فیھم ان کان مما یخالف الادلۃ القطعیۃ فکفر کقذف عائیشۃ و الا فبدعۃ و فسق
অর্থাৎ:- যদি এরূপ কোন কারণে সাহাবিদের গালাগাল করা হয় এবং ভর্ৎসনা করা হয়, যা অকাট্য দলীল বিরোধী তাহলে কুফরী হবে। যেমন- হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কে অপবাদ দেয়া। নতুবা তা বিদআত বা ফিসক (বড় গুনাহের অন্তর্ভুক্ত) হবে। (শারহে আক্বাঈদ)
বাহারে শরীআত এর মধ্যে রয়েছে -
"কোন সাহাবী সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করা, বদ মাযহাবী ও গোমরাহী ও জাহান্নামী হওয়ার লক্ষণ। কেননা, তা হচ্ছে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে শত্রুতা সমতুল্য। এ ধরনের লোককে রাফেযী বলা হয়। যদিওবা তারা চার খলিফাকে মান্য করে ও নিজেরা সুন্নী বলে দাবি করে। যেমন- হযরত আমীর মোয়াবিয়া ও তাঁর পিতা হযরত আবূ সুফিয়ান ও মাতা হযরত হিন্দা, অনুরুপ হযরত সাইয়্যিদুনা উমর বিন আস, হযরত মুগীরাহ বিন শোবা, হযরত আবূ মুসা আশয়ারী এমনকি হযরত ওহাশী রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহু যিনি ইসলাম কবুল করার আগে শহীদগণের সরদার হযরত সাইয়্যিদুনা হামযাহ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে শহীদ করেছিলেন এবং ইসলাম কবুল করার পর কুখ্যাত মুসাইলামা কাজজাবকে হত্যা করে জাহান্নামে পাঠিয়েছিলেন। তিনি নিজেই বলতেন আমি সর্বোত্তম ও সর্বনিকৃষ্ট লোককে হত্যা করেছি। তাদের মধ্যে কারো শানে বেয়াদবী করা জঘন্য পাপ এবং রাফেযীর অন্তর্ভুক্ত। যদিওবা এদের শানে বেয়াদবী শায়খাইন (হযরত আবূ বকর সিদ্দিক ও হযরত উমর) রাদিয়াল্লাহু আনহুমার শানে বেয়াদবী করার মতো নয় । কেননা ,শায়খাইন (অর্থাৎ হযরত আবূ বকর ও হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমার শানে বেয়াদবী করা অথবা তাঁদের খেলাফত অস্বীকার করা ফক্বীহগণের মতে কুফরী। (বাহারে শরীআত, 2/ 252-253, দাওয়াতে ইসলামী), واللہ أعلم بالصواب
Comments -