মহররম মাসে প্রচলিত লাঠি খেলা ও অন্যান্য খেল-তামাশা কি শরীয়ত সম্মত ?
মহররম মাসে প্রচলিত লাঠি খেলা ও অন্যান্য খেল-তামাশা কি শরীয়ত সম্মত ?
মুফতী আমজাদ হুসাইন সিমনানী
কুশমন্ডি, দক্ষিণ দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
সম্মানিত মুসলিম সমাজ! মহররম পালনের জন্য বাদ্যযন্ত্র সহ লাঠি খেলা আমাদের এলাকার খুবই জনপ্রিয় একটি প্রথা। এই মাসে মুসলিম যুবকেরা অতি আনন্দ-উল্লাসের সহিত বাদ্যযন্ত্র সহ লাঠি খেলা কে যেভাবে পছন্দ করে তেমনি অন্যদিকে এই লাঠি খেলা পরিদর্শন করে বহু মানুষ আনন্দ উপভোগ করতে পিছুপা হয়না। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এই লাঠি খেলা ও তা প্রদর্শন করা কে মানুষ বৈধ ও ইসলামিক কাজ মনে করে সম্পন্ন করে থাকে। বহু জায়গায় মুসলিম যুবকেরা মদ ও বিয়ার ইত্যাদি পান করেও এই খেল-তামাশায় লিপ্ত হয়। আসুন আমরা ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রচলিত লাঠি খেলা প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করি। ইসলাম শরীয়তে তিনটি খেলাকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বৈধ করেছেন। যেমন-
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
كُلُّ مَا يَلْهُو بِهِ الرَّجُلُ الْمُسْلِمُ بَاطِلٌ إِلاَّ رَمْيَهُ بِقَوْسِهِ وَتَأْدِيبَهُ فَرَسَهُ وَمُلاَعَبَتَهُ أَهْلَهُ فَإِنَّهُنَّ مِنَ الْحَقِّ
অর্থাৎ- মুসলিম ব্যক্তির জন্য তীর ছোড়া, ঘোড়া প্রশিক্ষণ দেওয়া ও নিজের স্ত্রীর সঙ্গে খেলা করা ব্যতীত প্রত্যেক খেল তামাশার বস্তু নিষিদ্ধ ।
{{ সুনানে তিরমিযী হাদীস নং-১৭৩৭,, সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস নং-২৯১৮,, মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা খন্ড-৪ পৃঃ-২২৯ হাদীস নং-১৯৫৪৯,, কান্জুল উম্মাল হাদীস নং-১০৮৬০ }}
ইমাম তিরমিযী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন- هذا حديث حسن
অর্থাৎ-হাদীসটি হাসান সনদে বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
ﺻﺤﺤﻪ ﺑﻦ ﺧﺰﻳﻤﺔ ﻭاﻟﺤﺎﻛﻢ
অর্থাৎ-হাদীসটি ইমাম ইবনে খুযায়মাহ ও ইমাম হাকিম রাহমাতুল্লাহি আলাইহিমা সহীহ বলেছেন।
{{ ফাতহুল বারী ১১/৯১ )
সম্মানিত পাঠক বৃন্দ! আপনারা অবশ্যই অবগত আছেন যে, মহররমের প্রচলিত লাঠি খেলা হাদীসে বর্ণিত উপরোক্ত বৈধ খেলা সমূহের অন্তর্ভুক্ত নয়।
এছাড়া কিছু উলামায়ে কেরাম শর্তসাপেক্ষ অন্যান্য কিছু খেলাকে জায়েজ বলেছেন। আর শর্তগুলো হলো- (১) শরীর চর্চার উদ্দেশ্যে তা সম্পন্ন করা। (২) খেলার কারণে শরীয়তের জরুরী কোন এবাদত কে পরিত্যাগ না করা যেমন নামাজ, রোজা, দ্বীনি শিক্ষা অর্জন ইত্যাদি। (৩) অপরিহার্য পর্দাকে বজায় রাখা। (৪) কোন মহিলার প্রতি দৃষ্টিপাত না করা। (৫) খেলায় জুয়া ও সাট্টা না লাগানো। (৬) কোন অবৈধ কর্ম খেলায় মিশ্রণ না করা ইত্যাদি।
প্রিয় মুসলিম সমাজ! মহররম মাসে প্রচলিত লাঠি খেলা কে যদি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে আপনি অবশ্যই জ্ঞাত হবেন যে, এই খেল তামাশা উপরোক্ত শর্তাবলী অনুযায়ী কখনো সম্পন্ন করা হয় না। অতএব জায়েয হওয়ার জন্য উলামায়ে কেরামের এই ফাতাওয়াটিও প্রয়োগ করা সম্ভব নয়।
সুধী পাঠক! বর্তমান সময়ে মহররমে প্রচলিত লাঠি খেলার সঙ্গে ইসলাম ও ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর কোনো সম্পর্কই নেই। কারণ মহররমের প্রচলিত লাঠি খেলার সঙ্গে অসংখ্য নাজায়েজ ও গুনাহের কর্ম মিশ্রিত হয়েছে, যেমন- খেলার জন্য ব্যান্ড পার্টি, ঢোল তবলা ও ক্যাসিও ইত্যাদি ব্যবহার করা, হাফ প্যান্ট পড়ে খেলাধুলা করা, গ্রামেগঞ্জে গিয়ে খেল প্রদর্শন করানো, খেলার কারণে নামাজ পরিত্যাগ করা, খেলা দেখার জন্য মহিলাদের একত্রিত হওয়া, যুবতী মহিলাদের দেখে নাচানাচি ও অতিরঞ্জিত কিছু কাজ করা, নকল ও ভুয়া কারবালায় অংশগ্রহণ করা, নাজায়েজ কর্মসমূহ সম্পন্ন করার সময় হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর পবিত্র নাম উচ্চারণ করা, মদ পান ও কোন হারাম বস্তু সেবন করে খেলায় অংশগ্রহণ করা, এক কথায় এ ধরনের বহু নাজায়েজ ও অবৈধকর্ম বর্তমান প্রচলিত লাঠি খেলার সঙ্গে যুক্ত। অতএব মহরমের প্রচলিত লাঠি খেলাকে সমর্থন করার অর্থই হলো, উপরোক্ত না জায়েজ ও অবৈধ কর্ম সমূহ কে সমর্থন করা। আর এই সমস্ত নাজায়েজ, অবৈধ ও বিদআত সম্বলিত কোন খেল-তামাশা ইসলাম শরীয়তে নাতো জায়েজ হতে পারে না আর না তা সমর্থন করা জায়েজ হবে। সুতরাং আমি সমস্ত মুসলিম যুবক এর উদ্দেশ্যে বলব, ধর্মের নামে ভন্ডামি, খেল তামাশা ও নাচ গান থেকে আজই তৌবা করে নিন এবং ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর নামকে বদনাম ও নিজের পরলৌকিক জীবনকে বরবাদ করা থেকে ফিরে আসুন যদি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ও আহলে বায়তে আতহার এর আপনি প্রকৃত প্রেমিক এবং ইসলাম ধর্মের সঠিক অনুসারী হতে চান।
কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেন-
ذَرِ الَّذِیۡنَ اتَّخَذُوۡا دِیۡنَہُمۡ لَعِبًا وَّ لَہۡوًا وَّ غَرَّتۡہُمُ الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَا وَ ذَکِّرۡ بِہٖۤ اَنۡ تُبۡسَلَ نَفۡسٌۢ بِمَا کَسَبَتۡ ٭ۖ
অনুবাদ- এবং বর্জন করো তাদেরকে, যারা নিজেদের দ্বীনকে খেলা তামাশারূপে গ্রহণ করেছে আর তাদেরকে পার্থিব জীবন প্রতারিত করেছে; এবং ক্বোরআন থেকে তাদেরকে উপদেশ দাও যাতে কখনো কোন প্রাণ নিজের কৃতকর্মের জন্য গ্রেফতার না হয়।
{{ সূরা আন'আম-৬ আয়াত নং-৭০ }}
الَّذِیۡنَ اتَّخَذُوۡا دِیۡنَہُمۡ لَہۡوًا وَّ لَعِبًا وَّ غَرَّتۡہُمُ الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَا ۚ فَالۡیَوۡمَ نَنۡسٰہُمۡ کَمَا نَسُوۡا لِقَآءَ یَوۡمِہِمۡ ہٰذَا ۙ وَ مَا کَانُوۡا بِاٰیٰتِنَا یَجۡحَدُوۡنَ ﴿۵۱﴾
অনুবাদ:-যারা তাদের দ্বীনকে খেল ও কৌতুক বানিয়ে নিয়েছে এবং পার্থিব জীবন তাদেরকে প্রতারিত করেছে। সুতরাং আজ আমি তাদেরকে পরিত্যাগ করবো যেমনি তারা এ দিনের সাক্ষাতের ধারণা পরিত্যাগের করেছিলো এবং যেমনি আমার নিদর্শনগুলোকে অস্বীকার করছিলো।
{{ সূরা আরাফ-৭ আয়াত নং-৫১ }}
আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত যুবক ভাইদেরকে ইসলামের সঠিক পথের পথিক হয়ে এবং হযরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর সঠিক প্রেমিক হয়ে জীবন অতিবাহিত করার শক্তি প্রদান করুন!
والله تعالى اعلم بالصواب
মুফতী আমজাদ হুসাইন সিমনানী
কুশমন্ডি, দক্ষিণ দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
Comments -